আজ মহান বিজয় দিবস। এ দিনটি হচ্ছে বাঙালি জাতির হাজার বছরের শৌর্যবীর্য এবং বীরত্বের এক অবিস্মরণীয় দিন। পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের নাম জানান দেওয়ার দিন। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর পশ্চিম পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কাছ থেকে এই দিনে আমরা মুক্তি ও বিজয় লাভ করি। পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশের গৌরব অর্জন করি আমরা।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃতে নয় মাস সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের এই দিনে বিকেলে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে) হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে নতুন রাষ্ট্র হিসেবে।
যে অর্থে আমাদের এই দেশ আজ স্বাধীন, সেই অর্থে বাংলাদেশ এর আগে আর কখনো স্বাধীন ছিল না। তাই বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাঙালি জাতির পিতা যে মূল্যবোধের জন্য বাঙালি সহস্র বছর সংগ্রাম করেছে, সেই মূল্যবোধগুলো বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের শাসনমূলে অন্তর্ভুক্ত করার যে পরিকল্পনা নিয়ে ছিলেন, তার স্বার্থক রূপ দিয়েছেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তথা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাই দল হিসেবে আওয়ামীলীগের গুণগত অবস্থান আর কাউকে বুঝিয়ে বলার অবকাশ নেই।
বাস্তবতা হচ্ছে– একটা রাজনৈতিক দলের আদর্শই যথেষ্ট নয়, সেই আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য যোগ্য নেতৃত্ব, সংগ্রাম, আত্মত্যাগ, সঠিক সময়ে বাস্তবতার উপলব্ধি ও সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে তার বাস্তবায়ন প্রয়োজন। সবচেয়ে বড় প্রয়োজন নেতৃত্ব। বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শোষিত ও বঞ্চিত মানুষের মুক্তির জন্য যে দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন, সেই কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্যই তিনি নানা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুন আওয়ামীলীগের আন্দোলনের কর্মসূচি ছিল মেহনিত মানুষের মুক্তি।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘যার যা কিছু আছে’ তা নিয়েই স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। পরে ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।
বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে বাঙালিরা অস্ত্র হাতে পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই মুক্তিযুদ্ধে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, ভুটান, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সাহায্য–সহযোগিতা করে। অবশেষে বাঙালি দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ করে বুকের উষ্ণ রক্তে রাঙিয়ে রাত্রির বৃন্ত থেকে ছিনিয়ে আনে ফুটন্ত সকাল।
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের মধ্যদিয়েই বঙ্গবন্ধুকে নিঃশেষ করতে পারেনি খুনিরা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সংহতির প্রতীক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এখনো তার জীবন, কর্ম ও বাণী দিয়ে জাতিকে শক্তি জুগিয়ে চলছেন। জীবিত বঙ্গবন্ধুর চেয়ে মৃত বঙ্গবন্ধু অনেক শক্তিশালী। আমরা নিশ্চিত, অনাগত দিনগুলোতেও বঙ্গবন্ধু হয়ে থাকবেন বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য অনিঃশেষ বাতিঘর। বঙ্গবন্ধু কেবল বাংলাদেশের নন, গোটা বিশ্বব্যবস্থায় বিবেকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। তিনি উদাত্ত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘বিশ্ব দুই ভাগে বিভক্ত– শোষক ও শোষিত। শেখ মুজিব শোষিতের পক্ষে।’ তাই আজও পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে স্বাধীনতা বা স্বাধীকারের প্রশ্ন এলে একজন শেখ মুজিবের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। ইতিহাসে যার স্থান সুনির্দিষ্ট ও স্বীয় মহিমায় সমুজ্জ্বল, তাকে অস্বীকারের মূঢ়তা বিপজ্জনক। বঙ্গবন্ধু কোনো নির্দিষ্ট দলের নন, তিনি সবার। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির জনক। গণ–মানুষের নেতা হিসেবে জনগণের মুক্তিদাতা হিসেবে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি যে ঘোষণা দিয়েছেলেন, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ সেই মুক্তি ও স্বাধীনতা ছাড়া বাংলার জনগণের জন্য বঙ্গবন্ধুর আর কোনো চিন্তা–ভাবনা ছিল না। বাংলাদেশ রাষ্ট্রে ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সবাই তার দেখানো পথে দেশ গড়ায় আত্মনিয়োগ করবেন, এমন প্রত্যাশা করা অসঙ্গত নয়। এ কথা কোনোভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সব সংগ্রাম ও সমৃদ্ধিতে দেদীপ্যমান দীপশিখা হয়ে থাকবেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যতদিন বাংলাদেশ আছে ততদিন বঙ্গবন্ধুর নাম কেউ মুছে দিতে পারবে না শত চেষ্টাতেও। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ এক ও অভিন্ন।
বিজয়ের এই ৪৯ বছর অনেক চড়াই–উতরাই পেরিয়েছে জাতি। বাংলাদেশকে বলা হয় এশিয়ার বাঘ। কখনো সামনে এগিয়েছে, আবার পিছিয়ে গেছে নানা রাজনৈতিক টানাপড়েনে। তবুও হতোদ্যম হয়নি জাতি। বিলম্বে হলেও শুরু হয়েছে ইতিহাসের দায়–মোচনের প্রচেষ্টা। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার সম্পন্ন হয়েছে। চলছে একাত্তরের মানবতাবিরোধী–যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। এর মধ্যে অনেকের বিচারের রায় কার্যকর হয়েছে। এ ছাড়া হার না মানা বাঙালি অর্থনৈতিক–সামাজিক এবং ক্রীড়াতেও ওড়াচ্ছে বিজয় নিশান।
এটা সত্য যে, আওয়ামীলীগকে নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্র হয়েছে। সবকিছু রুখে দিয়ে আজ আওয়ামী লীগ জনগণের দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। আওয়ামী লীগ মাটি ও মানুষের দল। স্বাধীনতার নেত্বদানকারী রাজনৈতিক দল হিসেবে জাতির ক্রান্তিকালে আলোকবর্তিতা হিসেবে আভিভূত হয়েছে। জননেত্রী শেখ হাসিনা আজ শক্ত হাতে দলের হাল ধরেছেন। দেশ ও জাতি শেখ হাসিনা নেতৃত্বে আছেন বলেই নিরাপদ বোধ করছেন। বাংলাদেশ স্বমহিমায় এগিয়ে যাক তার স্বকীয়তা নিয়ে, মহান বিজয় দিবসে এ প্রত্যাশাই করছি।
———--মো: খোরশেদ আহমেদ, সম্পাদক ও প্রকাশক (একাত্তরের দর্পণ)