ইন্টারনেটের অন্ধকার জগৎ বা ডার্ক ওয়েবে অর্ডার করা মাদকের চালান আসছে দেশে। মাদকের বড় চালানে ট্রানজিট হিসেবেও বাংলাদেশকে ব্যবহার করা হচ্ছে। অস্ত্র কেনাবেচায় আন্তর্জাতিক মাফিয়া চক্র ডার্ক ওয়েবে সংযুক্ত করছে দেশীয় অপরাধী চক্রকে। চাইল্ড পর্নোগ্রাফির একাধিক চক্রও এতে সক্রিয় হয়ে দেশি-বিদেশি শিশুদের ‘ন্যুড’ ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে দিচ্ছে।
এমনকি দেশীয় জঙ্গিরা আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে যোগসূত্রও স্থাপন করতে ডার্ক ওয়েব বেছে নিচ্ছে। বিভিন্ন সূত্র থেকে গোয়েন্দারা এমন তথ্য পাচ্ছেন। তবে এসব অপরাধীদের কার্যক্রম নজরদারি করার ক্ষেত্রে এখনো অনেক পিছিয়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর বলছে, করোনাকালে ডার্ক ওয়েবে মাদক কেনাবেচা বেড়েছে। এমন তথ্য তাদের কাছে রয়েছে। তবে দেশে কতজন মাদক কারবারি ডার্ক ওয়েবে সক্রিয় রয়েছে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। প্রযুক্তিগত সক্ষমতা না থাকায় এসব চক্রকে শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না।
ডার্ক ওয়েবে সক্রিয় মাদক কারবারিদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক মাফিয়া চক্রের যোগাযোগ আছে। এসব কারবারি মাদক কেনাবেচায় অবৈধ ক্রিপ্টোকারেন্সি বা বিট কয়েন ব্যবহার করছে। পরিচয় গোপন করে বিভিন্ন ধরনের অবৈধ ও নিষিদ্ধ পণ্য কেনা যায় বলে সারাবিশ্বেই ডার্ক ওয়েব অপরাধীদের কাছে জনপ্রিয়। মাফিয়া চক্র তাই সহজেই দেশীয় অপরাধীদের তাদের নেটওয়ার্কে অন্তর্ভুক্ত করতে পারে।
সংস্থাটির দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা জানান, ডার্ক ওয়েব ডিটেকশনের জন্য উন্নত এবং অত্যাধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োজন। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো এজন্য কোন ধরনের হাডওয়্যার এবং সফটওয়্যার ব্যবহার করছে সেগুলো নিয়ে পর্যালোচনা করা হচ্ছে। দক্ষিণ কোরিয়া ডার্ক ওয়েব ডিটেকশনের ক্ষেত্রে খুবই শক্তিশালী অবস্থানে আছে। তাদের প্রযুক্তির বিষয়েও খোঁজ নেয়া হচ্ছে। অনলাইনে নজরদারি এবং ডার্ক ওয়েব ডিটেকশনে আলাদা একটি সাইবার ইউনিট করার পরিকল্পনাও নেয়া হয়েছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আহসানুল জব্বার বলেন, অপরাধীরা তাদের মাদক কেনাবেচায় প্রতিনিয়ত পদ্ধতি পরিবর্তন করছে। এখন তারা অনলাইন এবং ডার্ক ওয়েবকে বেছে নিচ্ছে। এ কারণে আমরা সাইবার ইউনিট গঠন করার উদ্যোগ নিচ্ছি।
অধিদফতরের একজন কর্মকর্তা জানান, গত বছরের শুরুর দিকে হাসিব মুয়াম্মার রশিদ নামে এক যুবককে গ্রেফতারের পর তার মোহাম্মদপুরের বাসায় একটি ল্যাব পাওয়া যায়। সেখানে দেশে প্রথমবারের মতো নতুন ধরনের মাদক ক্রিস্টাল মেথ পাওয়া যায়। হাসিবকে গ্রেফতারের পরই মূলত জানা গেছে, দেশে ক্রিস্টাল মেথের বাজার তৈরির চেষ্টা করছে মাফিয়ারা। মালয়েশিয়ায় লেখাপড়া করার সময় নাইজেরিয়ানদের মাধ্যমে এই ক্রিস্টাল মেথের বিষয়ে জানতে পারে হাসিব। ডার্ক ওয়েবে মাদকের কেনাবেচার বিষয়েও তাদের কাছ থেকে জানতে পারে সে। ওই ঘটনা তদন্ত শুরুর চার মাস পর ওনিয়ানউসি নামে নাইজেরিয়ান এক নাগরিককে গ্রেফতার করা হয়। সে জানিয়েছে, ডার্ক ওয়েবে অর্ডার দেয়ার পর উগান্ডা থেকে ডিএইচএল কুরিয়ারে বাংলাদেশে ক্রিস্টাল মেথ আসে।
ওই কর্মকর্তা আরও জানান, নাইজেরীয় ওনিয়ানউসি ২০১৭ সালে বাংলাদেশের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি ফার্মা পাস করেন। তিনি পোশাক ব্যবসার নাম করে বাংলাদেশে থেকে যান। ভারত, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, উগান্ডা, কেনিয়া ও সিঙ্গাপুরে তিনি নিয়মিত যাতায়াত করতেন। উগান্ডা থেকে ডিএইচএল কুরিয়ারের মাধ্যমে আইসের চালান আনতেন ওনিয়ানউসি। শুধু ক্রিস্টাল মেথ নয়, অন্যান্য ধরনের মাদকও ডার্ক ওয়েবে কেনাবেচা হচ্ছে বলেও তথ্য পাওয়া গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুরো ইন্টারনেট দুনিয়ার মাত্র ১০ শতাংশ সাধারণ মানুষ ব্যবহার করছে। আর ৯০ শতাংশই অন্ধকার জগৎ যা সাধারণ ব্যবহারকারীদের সীমার বাইরে। ডার্ক ওয়েবে সক্রিয় মাফিয়াদের শনাক্ত করতে পুরো বিশ্বের প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থাগুলো হিমশিম খাচ্ছে। প্রযুক্তির দিক থেকে এগিয়ে থাকা দেশগুলোও ডার্ক ওয়েবে সক্রিয় অপরাধীদের বিষয়ে খুব বেশি তথ্য জানতে পারে না। তারা প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়াতে বিপুল পরিমাণ খরচ করছে।
পর্নোগ্রাফি বাণিজ্যে ডার্ক ওয়েব : পুলিশের বিশেষায়িত বিভাগ কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট সম্প্রতি শিশু পর্নোগ্রাফি চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেফতার করেছে। এই চক্রটি প্রথমে দেশি-বিদেশি শিশু ও কিশোরীদের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সম্পর্ক গড়ে কৌশলে ‘ন্যুড’ ছবি ও ভিডিও সংগ্রহ করত। পরে এগুলো অর্থের বিনিময়ে চাইল্ড পর্নো গ্রুপ ও ওয়েসবাইটগুলোতে সরবরাহ করত। সারা দুনিয়ায় ডার্ক ওয়েবের মাধ্যমে চাইল্ড পর্নো বাণিজ্য হয়। এই চক্রটিও মাফিয়াদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে ‘ন্যুড’ ছবি ও ভিডিও পাচার করেছে।
সংস্থাটির একজন কর্মকর্তা জানান, সারাবিশ্বেই শিশু পর্নোগ্রাফি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ডার্ক ওয়েব ব্যবহার করা হচ্ছে। গ্রেফতার এই চক্রের সদস্যরা পর্নোগ্রাফি গ্রুপের নির্দেশনা অনুযায়ী বাংলাদেশে কাজ করছিল।
পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের সিনিয়র সহকারী কমিশনার ইশতিয়াক আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, এই চক্রের সদস্যদের ডার্ক ওয়েবে বিচরণ ছিল। একটি ওয়েবসাইট সম্পর্কেও তথ্য পাওয়া গেছে। চাইল্ড পর্নোগ্রাফি ট্রেড নিয়ে আরও অনেক তথ্যও পাওয়া গেছে। এগুলো পর্যালোচনা করা হচ্ছে।
এদিকে সংস্থাটির একজন কর্মকর্তা জানান, শুধু চাইল্ড পর্নোগ্রাফি নয়, ডার্ক ওয়েবে জঙ্গিরাও তৎপর রয়েছে। আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনগুলো তাদের কর্মী সংগ্রহ থেকে শুরু করে মতাদর্শ প্রচারে ডার্ক ওয়েব বেছে নিচ্ছে।