বাংলাদেশ ও ভারত হাইড্রোকার্বন খাতে সহযোগিতা বিষয়ক সমঝোতার একটি কাঠামো (ফ্রেমওয়ার্ক অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং-এমওইউ) সই করেছে ঢাকা ও দিল্লি। বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে অনুষ্ঠিত ভার্চুয়াল সম্মেলনের আগে ঢাকায় এ সমঝোতা কাঠামো স্বাক্ষরিত হয়েছে।
এর আওতায় হাইড্রোকার্বন খাতে দ্বিমুখী বিনিয়োগ, প্রযুক্তি হস্তান্তর, যৌথ গবেষণা এবং সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সম্মত হয়েছে দুই প্রতিবেশী দেশ। ফলে বাংলাদশে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান এবং সরবরাহে ভারতের অংশগ্রহণ আরও বাড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ইতোমধ্যে ভারত চট্টগ্রাম পর্যন্ত জ্বালানি পাইপলাইনে তেল সরবরাহে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশে এলপিজি ও এলএনজিও সরবরাহ করতে চায়। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ইতোমধ্যে ভারতের বিপুল অংশগ্রহণ।
জ্বালানি পাইপলাইনে ভারত থেকে ডিজেল আসবে। লাইন নির্মাণ শুরু হয়েছে। অগভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে কাজ করছে ভারতীয় কোম্পানি ওএনজিসি। এলপি গ্যাস পরিবহনে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছে ভারত। ভারত থেকে হাজার মেগাওয়াটের ওপর বিদ্যুৎ কিনছে বাংলাদেশ। দুই দেশ যৌথভাবে কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে। এলএনজি সরবারহে সমঝোতা হয়েছে। এরমধ্যে বৃহস্পতিবার নতুন ফ্রেমওয়ার্ক অব তেল-গ্যাস খাতে দুই দেশের যৌথ অংশগ্রহণকে আরও দৃঢ় করবে বলে ঢাকা-দল্লির যৌথ বিবৃতিতে আশা প্রকাশ করা হয়েছে।
এতে বলা হয়, বৈদ্যুতিক শক্তি রূপান্তর, উৎপাদন, গ্যাস এবং পরিশোধিত পেট্রোলিয়াম পণ্য সরবরাহ এবং হাইড্রোকার্বন অনুসন্ধানে সহযোগিতার সম্ভাব্য অন্যান্য উপায়গুলোও অনুসন্ধান করা হচ্ছে। হাইড্রোকার্বন খাতসহ বৃহস্পতিবার বাণিজ্য, কৃষি, পরিবেশসহ বিভিন্ন খাতে পারস্পরিক সহযোগিতার সাতটি সমঝোতা স্মারক সই করেছে বাংলাদেশ ও ভারত।
এ বিষয়ে জ্বালানি বিভাগের সিনিয়র সচিব আনিছুর রহমান সমকালকে বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে জ্বালানিখাতে সহযোগিতার সম্পর্ক আগে থেকেই বিদ্যমান। ডিজেল আমাদনির জন্য পাইপলাইন নির্মাণ হচ্ছে, তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে কাজ করছে। এসব বিষয়কে একটা একক ফ্রেমের আওতায় আনতেই নতুন সমঝোতা হলো। ভারত বাংলাদেশে এলপিজি ও এলএনজি সরবরাহ করতে চায়। চট্টগ্রাম পর্যন্ত জ্বালানি তেল সরবরাহে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এ সমঝোতার আওতায় দুই দেশের মধ্যে জ্বালানি খাতে যৌথ সহযোগিতা আরও জোরদার হবে বলে মনে করেন আনিছুর রহমান।
এই ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাগ্রিমেন্টের ফলে দেশের তেল-গ্যাস খাতে ভারতের অংশগ্রহণ আরও বাড়বে বলে মনে করছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানি বিষয়ক এই বিশেষ সহকারী বলেন, বাংলাদেশ ভারত থেকে অনেকদিন আগে থেকেই বিদ্যুৎ কিনছে। ডিজেল আনতে যাচ্ছে। ওদের কোম্পানি আমাদের সমুদ্রে কাজ করছে। বিদ্যুৎকেন্দ্র বানাচ্ছে। নতুন সমঝোতার আওতায় জ্বালানি খাতের বিষয়গুলোকে একত্রিত করা হলো। এতে দর প্রক্রিয়ার বাইরেও জিটুজি ভিত্তিতে ভারতীয় কোম্পানি বাংলাদেশে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে অংশ নিতে পারবে।
২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফর করেন। এসময় বিদ্যুৎখাতে সহযোগিতার বিষয়ে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। পরবর্তী সময়ে ২০১৭ সালের এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে আরও সমঝোতা চুক্তি সই হয়। বিদ্যুৎখাতে সহযোগিতার জন্য দুই দেশের সচিব ও যুগ্ম সচিব পর্যায়ের স্টিয়ারিং ও ওয়ার্কিং কমিটি রয়েছে। ২০১০ সালের সমঝোতা স্মারকের অধীনেই কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় বাংলাদেশ ভারত বিদ্যুৎ সঞ্চালন কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়। ২০১৩ সালের ৫ অক্টোবর সঞ্চালন কেন্দ্রের মাধ্যমে ভারত থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি শুরু হয়। এই লাইনে বর্তমানে এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসছে। এছাড়া ত্রিপুরা থেকে ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি হচ্ছে। ভারতের বেসরকারি কোম্পানি রিলায়েন্স পাওয়ার ঢাকার অদূরে মেঘনাঘাটে ৭৫০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে। ভারতের আদানি পাওয়ার ঝাড়খন্ড রাজ্যে এক হাজার ৬০০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে, যার পুরো বিদ্যুৎ বাংলাদেশে রপ্তানি করবে। বাগেরহাটের রামপালে বাংলাদেশের বিপিডিবি ও ভারতের এনটিপিসি যৌথভাবে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে। ভারতের এপিম ব্যাংক বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ কোম্পানিকে ১৬০ কোটি ডলার ঋণ দিচ্ছে। বাংলাদেশের ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে ভারতের আসাম থেকে বিহার পর্যন্ত বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের বিষয়ে আলোচনা চূড়ান্ত পর্যায়ে। বাংলাদেশ ও ভারতের কোম্পানিগুলো এলএনজি খাতে সহায়তার তিনটি পৃথক চুক্তি করেছে। পেট্রোবাংলা ও ভারতের কুতুবদিয়া দ্বীপে একটি এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলাদেশের যশোর, খুলনা অঞ্চলে গ্যাস সরবরাহের জন্য পাইপলাইন নির্মাণে দুই দেশ সম্মত হয়েছে। ভারতের শিলিগুড়ি থেকে বাংলাদেশের পার্বতীপুর পর্যন্ত ১৩৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইনের নির্মাণ কাজ চলছে। এ কাজ সম্পন্ন হলে আসামের নুমালিগড় রিফাইনারি থেকে পরিশোধিত ডিজেল শিলিগুড়ি হয়ে দিনাজপুরের পার্বতীপুরের বিপিসির ডিপোতে সরবরাহ করা সম্ভব হবে। বর্তমানে রেলপথে ভারত থেকে ডিজেল আমদানি করছে বাংলাদেশ।
বাংলদেশের বেসরকারি কোম্পানির মাধ্যমে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে এলপিজি সরবরাহ করা হচ্ছে। ভারতের রাষ্ট্রীয় কোম্পানি ওএনজিসি ভিদেশ অগভীর সমুদ্রের ব্লক এসএস-০৪ এবং এসএস-০৯ এ তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে কাজ করছে। ইতোমধ্যে মোট ৫০৮১ লাইন কিলোমিটার ২-ডি সাইসমিক সার্ভে ও ডাটা বিশ্লেষণের কাজ সম্পন্ন করেছে। এসএস-০৪ আরও একটি অনুসন্ধান কূপ এবং এসএস-০৯ এ একটি অনুসন্ধান কূপ খননের জন্য প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম শুরু করেছে ওএনজিসি। এছাড়া বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানির অনেক অবকাঠামো খাতে ভারতের অনেক কোম্পানি কাজ করছে। বিশেষ করে সঞ্চালন লাইন, পাইপলাইন ও বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে প্রতিবেশী দেশটির অনেক কোম্পানি অংশ নিচ্ছে। দেশের অন্যতম বড় প্রকল্প রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ কাজে ভারত পরামর্শক হিসেবে কাজ করছে। এছাড়া নেপাল ও ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আমাদানির জন্য ভারতের সহযোগিতা প্রয়োজন বাংলাদেশের।