বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ১০:৪৮ অপরাহ্ন

মাইক্রোপ্লাস্টিক কেনো ভয়ংকর?

আইটি ডেস্ক / ৮৮ বার এই সংবাদটি পড়া হয়েছে
প্রকাশের সময় : শনিবার, ২৮ জানুয়ারী, ২০২৩

মাইক্রোপ্লাস্টিক’, ইদানিং এই শব্দটার সঙ্গে আমরা খুব বেশি পরিচিত হচ্ছি। তবে একটু ভয়ংকরভাবে। কারণ মানব শরীরের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ একটি পদার্থ হচ্ছে এই ‘মাইক্রোপ্লাস্টিক’। যা স্থলে বা পানিতে সর্বত্রই বিরাজমান। এটি প্রাণিজগতের জন্য খুবই হুমকির। ধারণা করা কঠিন হবে যে- আমরা যে সবজি এবং ফল খাচ্ছি তা এর থাবা থেকে মুক্ত নয়। গাজর, মুলা, শালগমসহ অন্যান্য মূল জাতীয় সবজিতে মাইক্রোপ্লাস্টিকের পরিমাণ অনেক বেশি থাকে।

পৃথিবীতে এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া যাবে না। অ্যান্টার্কটিক মহাসাগরের ওপর ভেসে বেড়ানো বরফ থেকে শুরু করে খাবার পানিতে মাইক্রোপ্লাস্টিক পৌঁছে গেছে। সামুদ্রিক প্রাণীর পেটেও এই প্লাস্টিক পাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা।

মাইক্রোপ্লাস্টিক আসলে কী? 

মাইক্রোপ্লাস্টিক হচ্ছে প্লাস্টিকের অত্যন্ত ক্ষুদ্র একটি অংশ। ২ থেকে ৫ মাইক্রোমিটার আকারের প্লাস্টিককে মাইক্রোপ্লাস্টিক বলা হয়। মাইক্রোপ্লাস্টিক সাধারণত নারডল নামে পরিচিত। নিত্যব্যবহার্য প্লাস্টিক বর্জ্য, কলকারখানা থেকে নির্গত বর্জ্য পদার্থে মিশে থাকা প্লাস্টিক প্রতিনিয়ত মিশছে পরিবেশে। তাপমাত্রা, অণুজীব এবং নানা কারণে এসব প্লাস্টিক ভেঙে পরিণত হচ্ছে ক্ষুদ্র প্লাস্টিকে বা মাইক্রোপ্লাস্টিকে।

দূরবর্তী দ্বীপ যেখানে কোনো মনুষ্যবসতি নেই, সেখানকার সৈকতও মাইক্রোপ্লাস্টিক থেকে মুক্ত নয়। স্থলভাগে, এমনকি খাবারেও মাইক্রোপ্লাস্টিক ঢুকে গেছে। নিজের অজান্তেই মানুষ প্রতিদিন প্লাস্টিকের টুকরো খাচ্ছে। যা শরীরের জন্য খুবই ঝুঁকির কারণ।

বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের ও ওজোন হ্রাসের পাশাপাশি মাইক্রোপ্লাস্টিক একটি বড় বৈশ্বিক পরিবেশগত সমস্যা হয়ে উঠেছে।

 

প্রশ্ন উঠতে পারে, ক্ষতিকর এই পদার্থ মানবদেহে প্রবেশ করে কীভাবে?

আকারে ক্ষুদ্র হওয়ায় এসব মাইক্রোপ্লাস্টিক মাটি, পানি বা বাতাসের সঙ্গে সহজেই মিশে যাচ্ছে। এর ফলে নষ্ট হচ্ছে পরিবেশের বাস্তুসংস্থান। নদীর স্রোত, বৃষ্টি, বন্যা প্রভৃতি বিভিন্ন উপায়ে এসব মাইক্রোপ্লাস্টিক পুকুর, নদী ও সমুদ্রে গিয়ে জমা হচ্ছে। খাবারের সামুদ্রিক ও স্বাদুপানির মাছের পেটে চলে যাচ্ছে মাইক্রোপ্লাস্টিক। ফলে সহজেই প্রাকৃতিক খাদ্যশৃঙ্খলে ঢুকে পড়ছে মাইক্রোপ্লাস্টিক। খাদ্যশৃঙ্খলের প্রথম স্তরের খাদককে দ্বিতীয় স্তরের খাদক ভক্ষণ করে; দ্বিতীয় স্তরের খাদককে তৃতীয় স্তরের খাদক ভক্ষণ করে; তৃতীয় স্তরের খাদককে সর্বোচ্চ স্তরের খাদক ভক্ষণ করে। এভাবে খাদ্যশৃঙ্খলের পর্যায়ক্রমিক পরিক্রমায় মাইক্রোপ্লাস্টিক মানবদেহে প্রবেশ করছে। ফলে মাইক্রোপ্লাস্টিক মানবস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে উঠছে দিনে দিনে।

মাটিতে মিশ্রিত প্লাস্টিক বিভিন্ন ধরনের অণুজীব যেমন সিউডোমোনাস, নাইলন খাদক ব্যাকটেরিয়া, ফ্লাভো ব্যাকটেরিয়া প্রভৃতির মাধ্যমে ভেঙে মাইক্রোপ্লাস্টিকে রূপান্তরিত হয়। এর ফলে মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হয়। মিথেন গ্যাস হলো অন্যতম গ্রিনহাউস গ্যাস। এ ছাড়া ক্লোরিনযুক্ত প্লাস্টিক বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ নির্গত করে। যেহেতু প্লাস্টিক মাটিতে পচতে সময় লাগে প্রায় ৪০০ বছর, সুতরাং ‌এটা একদিকে মাটির উর্বরতা নষ্ট করছে, অন্যদিকে এটি ভূগর্ভস্থ পানি ও ভূপৃষ্ঠীয় পানির সঙ্গে মিশে পানিকে দূষিত করছে। প্লাস্টিক দূষিত অবস্থায় প্রবেশ করছে আমাদের খাদ্যচক্রে।

প্রতি বছর প্রায় ৩৮০০ টন মাইক্রোপ্লাস্টিক পরিবেশের সাথে মিশে যায়, আর এটা আসে শুধু আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত প্রসাধন সামগ্রীর মাধ্যমে। এই পরিসংখ্যান কেবল ইউরোপ মহাদেশের। আমাদের মতো দেশ বা পৃথিবীর আরও সব দেশের হয়ে এই পরিমাণ কত হবে, তা বলা দূরূহ হবে। তবে তা যে সংখ্যায় বিশাল হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

লন্ডনের কিংস কলেজের এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ গ্রুপের অধ্যাপক ফ্রাঙ্ক কেলির দাবি, বাতাসেও মিশে এসব মাইক্রোপ্লাস্টিক বায়ুদূষণ করছে। কিন্তু বাতাসে এর ঘনত্ব নির্ণয় করা হয়নি। বাতাসে মাইক্রোপ্লাস্টিকের অন্যতম একটি উৎস সম্ভবত ফসলি জমিতে ব্যবহৃত সার। এসব সার শুকিয়ে গেলে তাতে থাকা মাইক্রোপ্লাস্টিক বাতাসে মিশে যায় বলে বিজ্ঞানীদের দাবি। এমনকি সিনথেটিক কার্পেট ও কাপড় থেকেও মাইক্রোপ্লাস্টিক বাতাসে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

 

আমাদের দেশে বিভিন্ন ধরনের নিত্যব্যবহার্য কসমেটিক, ডিটারজেন্ট, ফেসওয়াশ, স্ক্রাব, ক্রিম ইত্যাদিতে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে মাইক্রোপ্লাস্টিক। এমনকি টুথপেস্টেও ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব মাইক্রোপ্লাস্টিক কোনো প্লাস্টিক থেকে প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরি মাইক্রোপ্লাস্টিক নয়, বরং ইঞ্জিনিয়ারিং উপায়ে তৈরি করা মাইক্রোপ্লাস্টিক, যা এসব পণ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব পণ্য ব্যবহারের ফলে একদিকে যেমন আমাদের স্বাঁস্থ্যঝুকি বাড়ছে, অন্যদিকে পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। এসব কসমেটিক ব্যবহারের পর তা পানির সঙ্গে মিশে ভেসে যাচ্ছে খাল, নদী কিংবা সমুদ্রে। বর্তমানে অনেক বোতলজাত পানিতেও পাওয়া গেছে মাইক্রোপ্লাস্টিক। এ ছাড়া টি-ব্যাগের চায়ে মিশে যেতে পারে মাইক্রোপ্লাস্টিক। সাধারণত টি-ব্যাগ প্রাকৃতিক ফাইবার দিয়ে তৈরি হলেও তা এঁটে দিতে ব্যবহার করা হয় প্লাস্টিক। উচ্চ তাপমাত্রার প্রভাবে এসব থেকে মাইক্রোপ্লাস্টিক চায়ে ছড়িয়ে যেতে পারে। প্রায় ৯৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ফুটন্ত পানিতে ১১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ন্যানোপ্লাস্টিক তথা সেকেন্ডারি মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতির কথা জানিয়েছেন কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক। এ ছাড়া কাপড়ে ব্যবহৃত সিনথেটিক ফাইবার যেমন পলিইস্টার, নাইলন প্রভৃতিতেও মাইক্রোপ্লাস্টিকের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে।

এভাবেই প্রতিনিয়ত পরিবেশের প্রতিটি উপাদানের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে মাইক্রোপ্লাস্টিক, যার বিরূপ প্রভাব পড়ছে প্রাণিজগতের ওপর। এর ফলে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্য। ক্যানসার, হরমোনের তারতম্য, প্রজননপ্রক্রিয়ায় বাধা ছাড়াও মারাত্মক সব ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে মাইক্রোপ্লাস্টিক।

সম্প্রতি নতুন এক গবেষণা ‘এনভায়রনমেন্ট ইন্টারন্যাশনাল’ নামের একটি জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণাটি পরিচালনায় অর্থায়ন করেছে ডাচ ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর হেলথ রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কমন সিস। এটি একটি সামাজিক উদ্যোগ, যা প্লাস্টিক দূষণ কমাতে কাজ করছে।

দ্য গার্ডিয়ান জানায়, গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে যে, মানুষের রক্তেও প্লাস্টিকের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা বা মাইক্রোপ্লাস্টিক শনাক্ত হয়েছে।

গবেষণায় পরীক্ষা করা হয়েছে, এমন মানুষের মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশের রক্তে মাইক্রোপ্লাস্টিক পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা।

গবেষণায় যে বিষয়টি উদ্‌ঘাটিত হয়েছে, তাতে দেখা যায়, মাইক্রোপ্লাস্টিক রক্তের মাধ্যমে শরীরের অভ্যন্তরে চলাচল করতে পারে। শরীরের কোনো অঙ্গে মাইক্রোপ্লাস্টিক জমতে পারে।

রক্তে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতির বিষয়টি মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর কী প্রভাব ফেলে, তা এখনো বিজ্ঞানীদের অজানা।

তবে গবেষকেরা মাইক্রোপ্লাস্টিক নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন। কারণ, গবেষণাগারে পরিচালিত পরীক্ষায় দেখা গেছে, মাইক্রোপ্লাস্টিক মানুষের কোষের ক্ষতি করে।

আমাদের এই সভ্যতা অনেকখানিই প্লাস্টিক নির্ভর। প্লাস্টিকের উপস্থিতি এখন সবখানে। সেটা পানীয় জলে হোক, খাবারে হোক বা বাতাসে। প্লাস্টিকের উপস্থিতি নাই এমন একটা কিছুর নাম বলতে বলা হলে রীতিমতো গবেষণা করতে হতে পারে। এই প্লাস্টিকের সবই আবার বড় আকারের নয়। এর মধ্যে বেশিরভাগই মানদণ্ড মেনে গবেষণাগারে তৈরি করা প্লাস্টিক বা সিন্থেটিক পলিমার। আর এই পণ্যের মূল পোষকগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রসাধনী, রঙ, ওষুদ থেকে কৃষিজাত পণ্য উৎপাদনকারী। শুধু ইউরোপিয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো থেকে এই কয় ধরনের পণ্য থেকে বছরে প্রায় ৪২,০০০ টন প্লাস্টিক জাতীয় পরিবেশদূষক নিঃস্বরিত হয় মাইক্রোপ্লাস্টিক আকারে।

চিন্তার বিষয় হচ্ছে- আমাদের নিত্যকার জীবনে ব্যবহৃত এসব অতিসাধারণ পণ্য থেকে নিঃস্বরিত হওয়া এই মাইক্রোপ্লাস্টিক একবার পরিবেশের সাথে মিশে গেলে তা উঠিয়ে নিয়ে আসার কোনো পদ্ধতি এখনও আবিষ্কৃত হয়নি।এ অবস্থায় সচেতনতার বিকল্প নেই।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো সংবাদ