তিন বছর বয়সী রাইসা ও ৬ মাস বয়সী নাফিসা জানে না তারা মাত্র পিতৃহারা। ঢাকার আরমানিটোলার অগ্নীকাণ্ডে মুসা ম্যানসনের নিরাপত্তা কর্মী হিসেবে কর্মরত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করা রাসেল(৩০) তাদের পিতা। রাসেলের পিতা দেলোয়ার হোসেন বয়স ও অসুস্থতার জন্য প্রায় ১১ বছর পুর্বে মুসা ম্যানসনে ছেলে রাসেলের চাকুরি নিশ্চিত করে বাড়ি চলে আসেন। তিনিও একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে শোকে বিহ্বল। মা নুরজাহান তো শোকে ব্যকুল। একদিকে একমাত্র ছেলে রাসেল আগুনে পুড়ে মারা গেলে।
অন্যদিকে একই ঘটনায় ছেলের সাথে চাকুরি তার ভাই অলিউল্ল্যাহ (৫৬) একই ঘটনায় মৃত্যুবরণ করায় দুইটি মৃত্যুর শোক সইতে পারছিলেন না। বারংবার চিৎকার করে আহাজারি করছেন। ঢাকার আরমানিটোলার মুসা ম্যানসনের অগ্নীকাণ্ডে নিহত ৪জনের মধ্যে দুই জনের বাড়ি চাঁঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার ৮নং পাইকপাড়া দক্ষিণ ইউনিয়নের খুরুমখালী গ্রামে।
শনিবার সরেজমিন ওই গ্রামের গনি মেম্বারের বাড়ির অলি উল্ল্যার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় সর্বত্র সুনশান নিরবতা। বাড়ির প্রবেশ পথেই কবরস্থানে দুটি নতুন কবর। একটি অলিউল্যাহর ও অপরটি তার ভাগ্নে রাসেলের ।
অলি উল্যাহর ছোট ছেলে ছেলে সারাফত উল্ল্যাহ রিয়াদ জানান,শুক্রবার রাত সাড়ে ১১টা দিকে তার বাবা ও ফুফাতো ভাই রাসেলের মরদেহ বাড়িতে আসে। পরে রাত সাড়ে ১২টায় জানাজা শেষে উভয়কে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
রিয়াদ জানান, সর্বশেষ রোজা শুরু হওয়ার সপ্তাহ পুর্বে বাড়ি এসেছিলেন তার বাবা। কয়েকদিন থেকে রোজা শুরুর তিনদিন পুর্বে কর্মের টানে ঢাকা চলে যান। শুক্রবার ভোরে সেহরীর সময় অগ্নীকাণ্ডের কিছুক্ষণ পর তারা খবর পান ওই ভবনে আগুন লেগেছে। তার বাবার মুঠো ফোনে বারংবার কল করলেও তা রিসিভ করেন নি। তার বাবার লাশ সকলের পরে পাওয়া যায়। তাকে মুসা ম্যানসনের ছাদের একটি কক্ষে কবির নামে একজনের সাথে পোড়া অবস্থায় উদ্ধার করে লোকজন। তিনি বলেন, ছাদে তো আগুন পৌছে নি। তার লাশ সেখানে কিভাবে গেল, তা প্রশ্নবোধক।
রিয়াদ জানান, কর্মের টানে তার বাবা অলি উল্ল্যাহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কুয়েত যান। সেখানে কয়েক বছর চাকুরি করার পর ১৯৯২ সালে ইরাক যুদ্ধের সময় দেশে চলে আসেন। পরে এলাকায় দুই বার দোকান দিলেও ব্যবসায় লোকসান গুনে তার বন্ধ করে দেন। প্রায় ৮/১০ বছর পুর্বে তার বোন জামাই দেলোয়ার ও ভাগ্নে রাসেলের সুত্র ধরে ঢাকার আরমানিটোলার মুসা ম্যানসনে নিরাপত্তা কর্মীর চাকুরি নেন। নিহত অলি উল্ল্যাহ দুই ছেলে ও তিন মেয়ের জনক ছিলেন। বড় ছেলে মুরাদ সৌদি প্রবাসী। ছোট ছেলে রিয়াদ চাঁদপুর সরকারি কলেজ থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন। তিন মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন।
অন্যদিকে অলি উল্ল্যার ভাগ্নে রাসেলও গত গত প্রায় ১১ বছর ধরে মুসা ম্যানসনে নিরাপত্তা কর্মী হিসেবে চাকুরি করতেন। মামা অলি উল্যা ও ভাগ্নে একই সাথে চাকুরি করার কারণে অদল বদল করে তারা বাড়ি আসতেন। সর্বশেষ ২০/২২ দিন পুর্বে রাসেল বাড়ি আসেন। এসময় কয়েকদিন থেকে চলে যান। ৫ বছর পুর্বে তিনি বিয়ে করেন পাশ^বর্তী ফরিদগঞ্জ পৌর এলাকার কেরোয়া গ্রামের পাটওয়ারী বাড়িতে। তার তিন বছর বয়সী রাইসা ও ৬ মাস বয়সী নাফিসা নামে দুইটি মেয়ে রয়েছে। রাসেলের বাড়িতে গেলে দেখা যায় মৃত্যুর সংবাদ শুনে লোকজন বাড়িতে ভিড় করেছে। রাসেলের মা নুরজাহান বেগম ছেলে রাসেল ও ভাই অলি উল্যাহকে হারিয়ে শোকে কাতর হয়ে পড়েছে। লোকজন দেখলেই তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে।
রাসলের বাবা দেলোয়ার হোসেন জানান, তিনি দীর্ঘদিন ধরে আরমানিটোলার মুসা ম্যানসনের পাশে ছোট দোকান করে বিচাকিনি করতেন। মুসা ম্যানসন তৈরির পর ১১ বছর পুর্বে তিনি অসুস্থতার কারণে মুসা ম্যানসনের মালিক মোস্তাক আহমেদকে ধরে ছেলে রাসেলকে নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে চাকুরি নিয়ে দেন। পরে তিনি এলাকায় এসে নিজে বাড়ির সামনে এসে দোকান দিয়ে বসেন।
তিনি বলেন, ছোট ছোট শিশু দুইটি কিভাবে তাদের বাবার অভাব পুরণ করবে। কিভাবে চলবে আমার সংসার। জানি না, পর করুণাময় কেন আমার পরিবারের প্রতি এত নির্দয় হলো। তিনি জানান, মুসা ম্যানসনে আগুন লাগার পর সেখান থেকে কয়েকজন লোক পুর্ব পরিচয়ের সূত্র ধরে তাকে মুঠো ফোনে কল করে আগুনের কথা জানান। পরে তিনি রাসেলের মুঠো ফোন কল করলেও কেউ তা রিসিভ করেন নি। একই অগ্নীকাণ্ডের ঘটনায় একই পরিবারের দুইজনের মৃত্যু ঘটনায় দুই বাড়িতে শোকের মাতম বইছে। আত্মীয় স্বজনরা এসে শান্তনার বাণি দিয়ে গেলেও কিভাবে পরিবার গুলো চলবে, সেই চিন্তায় অস্থির তারা।